আদর্শ মাটির বৈশিষ্ট

আদর্শ মাটির বৈশিষ্ট

প্রায়ই বাগান তৈরির ক্ষেত্রে মাটিকেই সবচাইতে একঘেয়েমি মূলক বিষয় হিসেবে দেখা হয়। আদর্শ মাটির বৈশিষ্ট এর গুনাগুন জানা না থাকলে ভাল বাগান করা সম্ভব না। মাটি নিয়ে কাজ করা কখনই বাগানের গাছ নির্ধারন করার মত আকর্ষনীয় কাজ হয়ে ওঠে না। কিন্তু মাটি এমন একটি জিনিস যা পুরো বাগানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।যারা নতুন বাগানের কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন তাদেরকে চারা রোপনের আগেই মাটিতে টাকা এবং পরিশ্রম দিতে উৎসাহিত  করা হয়ে থাকে।কিন্তু খুব কম মানুষ সে কথা শোনে এবং চারা লাগানোর পরে চারাটিকে আরো পানি এবং খাবারের জন্য ধুঁকতে  দেখা যায়।বাগান তৈরির ক্ষেত্রে মাটির পুষ্টির দিকে নজর রাখলে মাটি নিজেই চারার পুষ্টির দিকে খেয়াল রাখবে।

বাগানের জন্য ব্যবহৃত মাটিতে সাধারনত ৯০% খনিজ এবং অবশিষ্ট  ১০% ক্ষয়প্রাপ্ত জৈব পদার্থ পাওয়া যায়। তারপরও এতে পোকামাকড় ও অণুজীব থাকে। মাটিতে অতিরিক্ত জৈব পদার্থ মেশানো হয় যাতে করে এইসব অণুজীব বেশি করে খাবার পায়, জৈব পদার্থ পঁচাতে সাহায্য করে ও বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান মাটিতে ত্যাগ করে। কেঁচো ও মাটিতে বসবাসকারী অন্যান্য পোকামাকড় তাদের চলাচলের মাধ্যমে মাটিতে বায়ু প্রবেশে সাহায্য করে এবং তাদের শরীর থেকে নির্গত বর্জ্য মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। এভাবেই ধীরে ধীরে মাটি উদ্ভিদের জন্য উপযোগী হয়ে ওঠে।

চারাগাছে কীটনাশক স্প্রে করা হলে তা মাটিতে পৌঁছে মাটির পোকামাকড় ও অণুজীবদের মেরে ফেলে।মাটিতে ব্যবহৃত সিনথেটিক সারের ভেতর থাকে নানা প্রকার লবন, যা মাটিতে বসবাসকারী পোকা ও অণুজীব মেরে ফেলতে পারে ও গাছের ক্ষতি করতে পারে। সিনথেটিক সার আদর্শ মাটির বৈশিষ্ট উর্বরতা বৃ্দ্ধি করতে পারেনা।

স্বাস্থকর মাটি বলতে কী বোঝায়?

মাটির উল্লেখযোগ্য ৪টি দিক রয়েছে। মাটির উপাদানের আকার, গঠন, পি এইচ, জৈব পদার্থ ও উর্বরতা।

১। মাটির উপাদানের আকারঃ

  • বালুঃ বালুর উপাদানগুলো সবচাইতে বড় এবং বিভিন্ন আকৃ্তির। একারনেই বালু কিছুটা অমসৃ্ন এবং এর মাঝে দিয়ে সহজেই পানি নিষ্কাশিত হয়। বালু সহজে জমাট বাঁধেনা।
  • পলিমাটিঃ পলিমাটির উপাদানগুলো বালুর চাইতে ছোট এবং বিভিন্ন আকৃ্তির হয়ে থাকে।
  • কাঁদামাটিঃ এর উপাদানগুলো ক্ষুদ্রাকৃ্তির এবং সমতল। এরা সহজেই জমাট বাঁধে এবং তখন এদের ভিতর দিয়ে বাতাস বা পানি কিছুই যাতে পারেনা।
  • স্যান্ডি লোমঃ স্যান্ডি লোম হল বাগানের জন্য সবচাইতে আদর্শ মাটি। এটিতে থাকে বাকি ৩ রকম উপাদানের সংমিশ্রন।

শুধু মাটির উপাদানের আকার-ই সবকিছু নয়। অন্যান্য বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।

২। মাটির গঠনঃ মাটির গঠন বলতে মাটি কিভাবে লেগে থাকে তা বুঝায়। এটি নিজে পরীক্ষা করেই যাচাই করা যায়। কিছুটা ভেজা মাটি হাতে নিয়ে বলের আকারের মত করুন। এখন এতে আঙ্গুল দিয়ে সামান্য চাপ দিতেই যদি ভেঙ্গে যায় তবে এটি বেলেমাটি। এটি যদি আরো চাপ নিতে পারে তাহলে এটি পলিমাটি আর যদি চাপ দেয়ার পরও না ভাঙ্গে তাহলে এটি কাদাঁমাটি। এভাবে সহজেই মাটির প্রকারভেদ আপনি জানতে পারবেন।

বাগানের জন্য ভালো মাটি সাধারনত ভঙ্গুর হয়। এতে করে গাছের মূল, বাতাস ও পানি সহজেই প্রবেশ করতে পারে।

দুই ভাবে মাটির গঠন আরো উন্নত করা যায়ঃ

প্রথমত, মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড়। এরা মাটির ভিতরে চলাচল করে এবং বাতাস ও পানির প্রবেশ্যতা বৃদ্ধি করে।

দ্বিতীয়ত,জৈব পদার্থ।এরা যেকোন রকমের মাটির জন্য ভালো।গাছের পাতা, সার এগুলো মাটির জৈব পদার্থ বাড়াতে সাহায্য করে।

আপনি মাটি চাষ করার মাধ্যমেও মাটি চারার জন্য উপযোগী করে তুলতে পারেন। কিন্তু চাষ করার কুফল হল এতে মাটি ভেঙ্গে যেতে পারে ও মাটির পোকামাকড় মারা যেতে পারে। তাই বাগানের মাটি নিয়মিত চাষ করা উচিত না।

৩। পি. এইচ. : পি. এইচ. হল মাটির অম্লতা (৭ এর নিচে) অথবা ক্ষারতার (৭ এর বেশি) পরিমাপক। বেশিরভাগ বাগানের গাছ-ই মাঝামাঝি মানের পি. এইচ. এর জন্য উপযোগী। আবার কিছু কিছু গাছের জন্য নির্দিষ্ট মানের পি. এইচ. দরকার। যেমন বেগুন গাছের জন্য পি. এইচ. এর মান ৭ এর বেশি হলে ভালো হয়। আবার পি. এইচ. এর মান ৭ এর কম হলে সেখানে ব্লুবেরী ভালো হয়। আপনি বাগানের বিভিন্ন জায়গা্য় বিভিন্ন মানের পি. এইচ. এর মাটি ব্যবহার করতে পারবেন।

সাধারনত আপনার বাগানের গাছগুলো যদি স্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে তাহলে আপনার বাগানের মাটির পি. এইচ. ঠিক আছে বলে ধরে নিতে পারেন। আর যদি স্বাভাবিকভাবে বাড়তে না থাকে তাহলে মাটির পি. এইচ. এর জন্য পরীক্ষা করানো উচিত। মাটির পি. এইচ. এর মান যদি উপযুক্ত সীমার মাঝে না থাকে তাহলে আপনি মাটিতে যতই সার বা জৈব পদার্থ দিননা কেন, গাছ কখনই মাটি থেকে তার দরকারী পুষ্টি পাবেনা।

বাজারে নানা রকমের পি. এইচ. পরিমাপক যন্ত্র পাওয়া যায়। আপনি বাগানের কিছু মাটি নিয়ে আশেপাশের কোন মাটি পরীক্ষার অফিসেও পি. এইচ. এর পরীক্ষা করাতে পারেন। মাটির পি. এইচ. এর মান জানতে পারলে এরপর সহজেই তা প্রয়োজন মত পরিবর্তন করতে পারবেন। পি. এইচ. এর মান বাড়াতে চাইলে চুন এবং কমাতে চাইলে সালফার যোগ করা হয়ে থাকে। কতটুকু কমাতে বা বাড়াতে হবে তা আপনি মাটি পরীক্ষা করেই জানতে পারবেন।

চুন অথবা সালফার যোগ করে পি. এইচ. এর মান পরিবর্তন করা একটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ। খু্ব  তাড়াতাড়ি এর ফলাফল পাওয়া যায় না। তাই কিছু  দিন পর পর মাটি পরীক্ষা করাতে হয় যাতে পি. এইচ. এর মান খুব বেশি পরিবর্তন হয়ে না যায়।

৪। জৈব পদার্থঃ জৈব পদার্থ বাগানের জন্য এত বেশি উপকারি যে এর উপকার না নেয়াটা-ই একরকমের বোকামী। জৈব পদার্থ ছাড়া কোন বাগান-ই সম্ভব না।পচাঁনো জৈব পদার্থ থেকে পাওয়া উপাদান-ই গাছপালা খেয়ে থাকে।দূর্ভাগ্যজনক ভাবে আমরা সচরাচর বাগানে কোন মরা  গাছ দেখলে তা সরিয়ে ফেলি যা উচিত না। বরং এগুলোকে বাগানের মাটিতে পরে থাকতে দিলে সেটা বাগানের মাটিকে পুষ্টি দেয়ার পাশাপাশি মাটির ক্ষয় রোধ করতে ও আর্দ্রতা রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

বাগানের মাটিতে জৈব পদার্থ প্রয়োগ করলে তা মাটির গঠনের উন্নতি ঘটায় ও পোকামাকড়ের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাটিতে যত বেশি মাটির জন্য উপকারী অণুজীব থাকবে, ততই কম ক্ষতিকর পদার্থ থাকবে। আদর্শ মাটির বৈশিষ্ট জন্য উপকারী অণুজীবগুলো ক্ষতিকর পদার্থগুলো খেয়ে ফেলে। তারা মারা যাবার পর  তাদের মৃতদেহ হতে মাটি পুষ্টি পায়।এজন্য মাটিতে যত বেশি অণুজীব থাকবে ততবেশি মাটি গাছকে দেবার জন্য পুষ্টি পাবে। কিছু কিছু জৈব পদার্থের ভেতর এমন কিছু অম্ল থাকে যা গাছের মূলকে পানি শোষন করার জন্য আরো বেশি উপযোগী করে তোলে। এই অম্ল খনিজ পদার্থ গুলোকে মাটিতে দ্রবীভূত করে গাছের খাবার হিসেবেও উপযোগী করে তোলে।

জৈব পদার্থের প্রকারভেদঃ

  • কম্পোস্টঃ  কম্পোস্ট হল জৈব পদার্থের সবচাইতে সরলতর রূপ। যেকোন জৈবিক পদার্থ পঁচে গেলে তা থেকে কম্পোস্ট পাওয়া যায়। আপনি নিজেই এটি বানাতে পারেন অথবা দোকান থেকে কিনতে পারেন। এটি দেখতে অনেকটা মাটির মতই। এটি যেকোন সময় বাগানে প্রয়োগ করা যাবে। এছাড়াও ঘাস, লতাপাতা, সবজির ফেলে দেয়া অংশ কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • সারঃ পশুপাখির বর্জ্য সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে সারটি যেন কমপক্ষে ৬ মাস থেকে ১ বছর পুরনো হয়। নয়তো এটি গাছের ক্ষতি করতে পারে।
  • সবুজ সারঃ এগুলো হল গাছের সেই অংশ যা পরবর্তীতে  জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি সবজি বাগানের জন্য বেশি উপযোগী।

৫। মাটির উর্বরতাঃ ভালো মাটির জন্য পুষ্টি হল আবশ্যিক উপাদান। মানুষের মতই গাছেরও বেড়ে উঠতে  ও বিভিন্ন রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পুষ্টির প্রয়োজন। মাটি থেকে যে পুষ্টি নিয়ে নেয়া হয়, মাটিতে জৈব সার প্রয়োগ করে তা আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়। জৈবিক সার খুব ধীরে ধীরে কাজ করে। এতে করে মাটিতে কোন আকস্মিক পরিবর্তন হয়না।

স্বাস্থকর, উপযোগী মাটি তৈ্রি করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আদর্শ মাটির বৈশিষ্ট ভালো হলে খুব সহজেই একটি ভালো বাগানের আশা করা যায়। পরের অংশে এই বিষয়ে আরও কিছু আমরা জানতে পারবো

 

..

 

 

 

Sell Your Product With Us

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Want to write on Methopoth? Submit your article here ...